সেগুফতাকে নিয়ে সমাজে অনেক ধরণের কথা চালু আছে। সে থাক। সেগুফতা, যার ডাক নাম ঝিলিক, জানে তার মতো বিবাহ বিচ্ছিন্না, সুন্দরী, স্বাধীন মেয়েদের নিয়ে শুধু পুরুষরাই নয়, বরং বহু মেয়ে বা মহিলাও বিষোদ্গার করা পছন্দ করে।
এ নিয়ে শুরু শুরুতে প্রচন্ড মনোকষ্টে ভুগতো ঝিলিক। ভাবতো, সে তো সংসারটা ভাঙতে চায়নি। ভালোবেসে আবীরের হাত ধরে আজন্ম পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সে-ই তো বেরিয়ে এসেছিলো সংসার করতে। যার জন্য চিরদিনের মত বাবার বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করতে হয়েছিল তাকেই, অথচ পরকীয়া করে আবীর তাকে বের করে দিয়ে নতুন সংসার করলেও সব দোষ নাকি তারই!
আরো আশ্চর্য হয় ঝিলিক কারণ বিদেশে থেকেও এই সব দোষারোপ, মন্তব্যের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে! বিয়ের কয়েকমাস পরেই তারা অস্ট্রেলিয়া চলে এসেছিলো। ঝিলিকের স্টুডেন্ট ভিসা তাদের বিয়ের দিনই পেয়েছিলো, আর আবীরও কয়েকদিনের মধ্যেই তার কাঙ্খিত স্টুডেন্ট ভিসা পেতেই দেশের পাট চুকিয়ে দুজনে চলে এসেছিলো চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে।
দুজনেই স্টুডেন্ট হওয়ায়, নির্দিষ্ট সময় কাজ করে কিছুতেই কুলাতে পারত না ওরা, আর তাই রাতের বেলা বাড়তি কাজ নেয় আবীর। ফলাফল, লেখা পড়ায় ঠিকমত ফোকাস না করতে পেরে এক পর্য়ায়ে পড়াই ছেড়ে দেয় আবীর। সে সময় স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাকে ঝিলিকের স্বামী হিসেবে স্পাউস ভিসা নিতে হয়। এদিকে ভাল ছাত্রী হওয়ায় তরতর করে এগিয়ে চলে ঝিলিক।
ঝিলিক সন্মানজনক জব করবে আর আবীর নেহাতই একজন ক্লিনার, একথা ঝিলিক মানতে পারলেও প্রচন্ড হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে আবীর। দিনেদিনে তার হীনমন্যতা বাড়তেই থাকে আর তার সাথে সুযোগ পেলেই ঝিলিককে হেয় করা বা সন্দেহ করাও বাড়তে থাকে।
আবীরের মনের অবস্খার কথা ভেবেই ছাড় দিতে থাকে ঝিলিক আর চেষ্টা করে যায় আবীরকে আবার পডাশুনোয় ফেরাতে। আবীরের কিন্তু ততদিনে নিজস্ব একটা বলয় তৈরী হয়ে গেছে যার কোন খোঁজই ঝিলিক পায়নি। তার লেখাপড়া আর চাকরীর বাইরের প্রত্যেকটা মূহুর্ত তোলা থাকত শুধু আবীরের জন্য, অথচ কাজের বেশ ক’জন বন্ধু বান্ধব নিয়ে কাজের বাইরেও সময় কাটাতে শুরু করে আবীর। তাও মেনে নিতে চেষ্টা করে ঝিলিক, কিন্তু হঠাৎ করেই তার সাধের সংসার তাসের ঘরের মত ছড়িয়ে পড়ে তার চারপাশে।
একদিন প্রচন্ড শরীর খারাপ হওয়ায় অসময়ে ঘরে ফিরে আবীরকে আপত্তিকর অবস্থায় পায় আরেকটা মেয়ের সঙ্গে। স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ঐ মেয়েকে নিয়ে ধীরে সুস্থে আবীরের চলে যাওয়া। যাওয়ার আগে ঝিলিককে আবীর শুনিয়ে যায় মেলিসাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত। ঝিলিক চাইলে(!) তাকে ডিভোর্স দেবার আশ্বাসও দিয়ে যায়। এটা যে সে ব্যঙ্গ করেই বলে, সেটা বোঝে ঝিলিক।
প্রথমেই একজন লকস্মিথ ডেকে সদর দরজার তালাটা পাল্টে নেয় সে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেই ভেবে নেয় বাড়ি ছেড়ে যাবে না সে। বান্ধবীর হাত ধরে যে বেরিয়ে গেছে, সে বুঝুক কোথায় রাত কাটাবে। এরপর দুতিনজনের সঙ্গে পরামর্শ করে নেয় কি করণীয়। সেভাবেই জয়েন্ট একাউন্ট থেকে আবীরের জন্য তার রোজগারের টাকাটা রেখে বাকীটা সরিয়ে নেয় ঝিলিক।
তারপর বিভিন্ন মহিলাদের গ্রুপের সহযোগীতায় একে একে পরের ধাপ গুলোয় ভালভাবেই পার হয় সে। এর মধ্যে যৌথভাবে কেনা সম্পত্তি নিস্পত্তি করতে গিয়ে আবীরই ঝিলিকের অংশটুকু কিনে নেবে জানায়। ঝিলিকও ভেবে দেখে একদিক দিয়ে ওর জন্য ভালই হয়, কারণ নিজের হাতে সাজানো তাদের দুজনের এই এ্যাপার্টমেন্টে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে আজকাল। যদিও ন্যায্য দামের চাইতে কিছুটা কমই বোধয় পেলো ঝিলিক, তবু তা নিয়ে আর বেশী মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না ঝিলিকের।
অবশেষে চলে আসে ঘর ছেড়ে যাওয়ার দিন। সঙ্গে করে ঘরের কোনোকিছুই নিয়ে যাবে না ভেবেছে ঝিলিক, আর তাই যাওয়ার আগে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে শেষবারের মত নিজের হাতে সাজানো ঘরে খেতে বসে। । কয়েকদিন থেকেই নষ্ট হতে পারে এমন খাওয়া দাওয়া, শাক সবজি প্রায় শেষ করে এনেছে সে, বাকিটুকু একটা গার্বেজ বাগে ভরে বাইরে ফেলে দিলেই চলবে। ফ্রিজ খুলে কি খাবে আর কি ফেলবে দেখতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পরে বান্ধবী শায়লার দেওয়া সিঁদল শুটকির ভর্তাটার দিকে। এই জিনিস সে অসম্ভব পছন্দ করে, কিন্তু এর গন্ধ আবীর একেবারেই সহ্য করতে পারে না, তাই বিয়ের পর থেকে এই উপাদেয় বস্তুটা ঘরে আর ঢোকায়ইনি সে। কি লাভ হল আবীরের জন্য নিজের ছোট বড় অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়ে? সেই তো তাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের কাছে যেতে একটুও আটকালো না আবীরের।
হঠাৎ করেই কিছু একটা ভেবে খুশী হয়ে যায় ঝিলিক। আবীরের করা সব অন্যায়ের জবাব হয়ত দেওয়া যাবে না, কিন্তু তার নিজের হাতে সাজানো এই এপার্টমেন্টে রঙ্গিলা গার্লফ্রেন্ড নিয়েও যাতে সুখের বাসর করতে না পারে, সেই ব্যবস্থাই করবে সে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দ্রুতহাতে বেডরুমের পর্দার রডটা খুলে নেয় ঝিলিক, তারপর পর্দাটা এক পাশে ঠেলে, লম্বা একটা আইসক্রিমের চামচে করে সবটুকু সিঁদল শুঁটকি ঠেসে ঠেসে রডের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। এরপর আবারো পর্দা ঠিকঠাক করে ঝুলিয়ে রেখে দেয় সে, তারপর খেয়ে দেয়ে, সবকিছু ধুয়ে রেখে শেষবারের মতো সাজানো এপার্টমেন্টটার দিকে এক নজর দেখে বেরিয়ে যায় ঝিলিক। ঘরের চাবি সে একটা এনভেলাপে ভরে লেটার বক্সে ঢুকিয়ে রেখে যায়। আবীরকে সেভাবেই বলা আছে।
পরের দিনই মেলিসাকে নিয়ে এপার্টমেন্টে উঠেছিল আবীর। আসার সময় মেলিসা বুদ্ধি করে কিছু সেন্টেড ক্যান্ডল আর শ্যাম্পেনের একটা বোতলও নিয়ে এসেছিল। নিজের একক মালিকানায় প্রেয়সীকে নিয়ে প্রথম রাতটা স্মরণীয় করে করে রাখার জন্য আবীরও তাদের দুজনের প্রিয় সী-ফুড প্লেটার অর্ডার করে রেখেছিলো। এত বড় প্লেটার হবে বুঝতে পারেনি যদিও, আর তাছাড়া খাওয়া দাওয়ার চাইতেও মেলিসার সঙ্গসুখের কল্পনায় সবটা শেষ না করেই শুতে চলে যায় তারা। এর মধ্যেই সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে মোহনীয় রাতপোশাক পরা মেলিসাকে দেখে নিজের মনেই ঝিলিকের ওপর নেওয়া প্রতিশোধটা খুব মধুর মনে হয়।
আরেকজন বাংলাদেশী ছাত্রীর সঙ্গে দুই বেডরুমের একটা শেয়ার্ড এপার্টমেন্টে থাকছে আপাতত ঝিলিক। দেখে শুনে জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে হবে এবার। পুরুষমানুষের ওপর যে অবিশ্বাস আর বিতৃষ্ণা জমা হয়েছে মনে, তাতে সহসা আর ওপথে পা দেবেনা সে। আবীর আর তার দুএকজন কমন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রেখেছে আপাতত, কারণ তার জানতে হবে নিজের ফ্ল্যাটে কেমন কাটছে আবীর-মেলিসার দিনকাল। জানা হয়ে গেলেই এদেরকেও ছাঁটাই করে দেবে। নাঃ, বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না তার। মাসখানেকের মধ্যেই জানতে পারে এপার্টমেন্টে বোঁটকা একটা গন্ধের জন্য টেঁকা দায় হয়ে পড়েছে ওদের। অনেক খুঁজেও গন্ধের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রফেশনাল ক্লিনার দিয়ে, পেস্ট কন্ট্রোল দিয়ে সাফাই করিয়েও অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়ায় শেষমেশ এপার্টমেন্টটা বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। মেলিসা নাকি প্রচন্ড বিরক্ত এবং সহসা বিয়ে করার যে প্ল্যান ছিল ওদের, আপাতত তাও স্থগিত।
পরের মাসে নিজেদের পুরোনো এপার্টমেন্টের সামনের রাস্তা দিয়ে একটা কাজেই যাচ্ছিলো ঝিলিক। হঠাৎ চোখে পরে বাড়ির সামনে একটা মুভার্স এর ভ্যান আর তাতে জিনিসপত্র তুলছে মেলিসা। ব্যস্ততার ভেতর ঝিলিক কে না দেখলেও, ভ্যানে তোলা জিনিসের মধ্যে ফ্রেঞ্চ লেসের পর্দা শুদ্ধু পর্দার রডও চলেছে নতুন ঠিকানায় সেটা ঠিকই চোখে পরে ঝিলিকের। পৰ্দা বা রড সাধারণত কেউ নেয় না, কিন্তু পর্দাগুলো খুবই দামি এবং প্রায় নতুনই বলা চলে, আর পর্দার দুদিকের দু মাথার ট্যাব গুলো ঝিলিক এমন ভাবে সুপার গ্লু দিয়ে সেঁটে দিয়েছিলো, যে টানাটানি করে খুলতে গেলে ছিঁড়ে যেতে বাধ্য। এজন্যই পর্দার মায়া ছাড়তে না পেরে শেষতক তার সিঁদল ভরা রড নিয়েই নতুন বাড়িতে যাচ্ছে মেলিসা! আঃ! নতুন বাড়িতে সিঁদলের গন্ধ কতটা অবাক আর বিরক্ত করবে আবীর-মেলিসাকে , সেটা ভেবে নিজের অজান্তেই একটা হাসি ফুটে ওঠে ঝিলিকের মুখে। শেষ হাসিটা তবে সেই হাসলো । সুইট রিভেঞ্জ !!
II একটি বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে II
Leave a Reply