সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ০১:৪৫ পূর্বাহ্ন

মন থাকলে মন খারাপও হবে, কিন্তু তাই বলে থেমে থাকলে চলবে না – প্রবাসে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার লড়াইটা শুরু হোক নিজের থেকেই

সুতপা বড়ুয়া
  • Update Time : শুক্রবার, ৩০ মে, ২০২৫
  • ১৫০ Time View

Stress, Depression, Anxiety মারাত্বক তিনটে ব্যাপার যা যে কোনো মানুষকে শেষ করে দিতে পারে। এসবই প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের অতি সাধারণ কিছু mental health issues। এছাড়াও রয়েছে PTSD বা Post Traumatic Stress Disorder যেখানে stress disorderটা ঘটছে traumaর কারণে।

অনেকেই, আসলে বেশির ভাগ লোকই এই ব্যাপারগুলোকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। Stress শব্দটা বোঝাতে আমরা সাধারণতঃ ব্যবহার করে থাকি Tension। বাংলাতে এটার সঠিক মানে কি? এর মানে <কঠিন মানসিক চাপ>

Depression মানে < বিষণ্ণতা বা কঠিন মন খারাপ> যা একটানা দু সপ্তাহ বা তার তার চেয়ে বেশি দিন ধরে রয়েছে আর Anxiety হল <দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা বা উদ্বেগ>

মাথা থাকলে যেমন কখনো কখনো মাথা ব্যাথা করতেই পারে, ঠিক তেমনি মন থাকলে মন খাৱাপও হতেই পারে, এবং সবার হয়। তাহলে? এটা নিয়ে এতো হৈ চৈ, এতো মাথা খারাপ করার কি আছে? আছে, আছে, কারণ ওই যে শুরুতে বলেছি Stress , Depression, Anxiety মানুষকে শেষ করে দিতে পারে, সেটা কিন্তু শুধু কথার কথা ছিল না।

অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন মনের সঙ্গে শরীরের একটা বিশেষ যোগাযোগ আছে। যেদিন কোন কারণে মন খারাপ থাকে, সেদিন শরীরটাও যেন ম্যাজম্যাজ করে, কোন কিছু করতে ভালো লাগে না, খেতে ভালো লাগে না, ক্লান্ত থাকলেও ঘুম ভালো হয় না। ঠিক একই ভাবে মনের ওপরেও শরীরের সরাসরি প্রভাব আছে এবং এগুলো interlinked, অর্থাৎ স্ট্রেস থেকে আমাদের শরীরে বেশ কিছু হরমোন এর নিঃসরণ বেড়ে যায়, যার মধ্যে cortisol নামের হরমোনটা আমাদের আস্তে আস্তে কুরে কুরে খেয়ে ফেলতে পারে!

করটিসল হরমোন নামের ভয়ঙ্কর দানবটা বেড়ে গেলে প্রথম প্রথম ওজন বেড়ে যাওয়া, মুখে ব্রণ, ক্লান্তি বা অবসাদের মতো ছোট খাটো ব্যাপার দিয়ে মাথা চাড়া দেয়। এরপর যদি আমাদের স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বাড়তে থাকে , তখন পাল্লা দিয়ে করটিসল নামের হরমোনটা উচ্চ রক্ত চাপ, ডায়াবিটিস, immune suppression বা শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, Osteolysis বা হাঁড়ের ক্ষয়, পেশী (muscle )র ক্ষয়, এবং Atherosclerosis বা ধমনীতে চটচটে প্লাক জমে সেগুলো সরু হয়ে যাওয়া, যার ফলে হৃদপিন্ডে রক্ত চলাচল ঠিকমত হয় না। এভাবেই Stress বা টেনশন নামের দানব তার বিশ্রী নখ, দাঁত বের করে ধীরে ধীরে আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এজন্যই বলে stress kills, কারণ যদিও স্ট্রেস আপনাকে সরাসরি মেরে ফেলে না, কিন্তু এর দরুন দেহ এবং মনের ওপর এমন ভয়ঙ্কর চাপ পরে যে মানুষের আকস্মিক এবং সময়ের আগে মৃত্যু হতে পারে। স্ট্রেস এর দরুন আত্মহত্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায়!

কিন্তু শুধুই কি তাই? এগুলো তো নারী পুরুষ নির্বিশেষে হয় প্রায় সব অভিবাসীদেরই। নারী অভিবাসীদের কিন্তু এসব ছাড়াও কিছু বিশেষ সমস্যা থাকে যেগুলো তাদেরকে আরো বেশি নাজুক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করে। কি সেগুলো শুনবেন?

এক নম্বরে আছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (social isolation) বা একাকিত্ব। পুরুষ রুটি রুজির প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, কিন্তু ভাষাগত সমস্যা (language barrier), দ্বিধা, সংকোচ, আর্থিক পরনির্ভরতা, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে এবং নিজস্ব অধিকার সম্বন্ধে ধারণা না থাকার ফলে একজন নারীর লড়াইটা আরো অনেকটা বেশি কঠিন।
নিজের দেশে আত্মীয়, স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবের মধ্যে থাকার যে সুফলটা সে না জেনে বুঝেই পেয়ে এসেছে, ভিন দেশে এসে হঠাৎ করে বন্ধু, স্বজনহীন হয়ে পড়ে নারী যেন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খায়।

এ সময়ে তার মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়ে পরে এবং যা কিছু তার পরিচিত বা নিজস্ব পরিচয়ের অংশ ছিল, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে সে একটা প্রচন্ড মানসিক ধাক্কা খায়। চিকিৎসা শাস্ত্রে একেই বলে ট্রমা বা আঘাত আর এর পরবর্তীতে যে অসুখটা দেখা দেয় , সেটাকেই বলে PTSD (Post Traumatic Stress Disorder).

এই অসুখটার কথা বেশি শোনা যায় যুদ্ধ ফেরতা সৈনিকদের ক্ষেত্রে। একটা যুদ্ধের বীভৎসতা সম্বদ্ধে তো কম বেশি আমরা সবাই জানি। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সৈনিকের শরীরে এবং মনে যে আঘাত থেকে যায়, তার থেকে তার শারীরিক এবং মানসিক বৈকল্য বা অসাড়তা দেখা দেয় এবং সঠিক চিকিৎসা, সহমর্মিতা না পেলে সে কিন্তু সারাজীবনের জন্য শারীরিক বা মানসিক ভাবে পঙ্গু হয়ে পড়তে পারে এমনকি মারাও যেতে পারে।

ঠিক একই ভাবে, চিরপরিচিত সব কিছু থেকে সমূলে উপড়ে এসে নতুন একটা দেশের নতুন পরিবেশ, আবহাওয়া, নিয়ম কানুন, ভাষা সব কিছুর একা একা মোকাবিলা করতে গিয়ে নারীও প্রচন্ড মানসিক আঘাতের মুখোমুখি হয়, এবং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা, পরিচর্যা না পেলে সেও PTSD তে আক্রান্ত হয়। তাই এই দূর প্রবাসে একটু সহমর্মীতা আমাদের জীবনদায়ী অমৃত সুধার কাজ করে। এই সহমর্মীতা পাওয়ার জন্য সঠিক বন্ধু বাছাই করতে পারাটা সবিশেষ জরুরি। বন্ধু যে সবসময় নিজের ভাষা বা সংস্কৃতিরই হতে হবে, তা কিন্তু নয়। তারপর সেই বন্ধুত্বের পরিচর্যা করতে হবে, অর্থাৎ বন্ধুত্বটা যেন একতরফা না হয়।

খুঁজে নিতে হবে পছন্দসই কিছু ব্যাপার, যেমন যারা গল্পের বই পড়তে ভালোবাসেন, তারা কাছাকাছি লাইব্রেরির খোঁজ করে সেখানকার কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজে সেকশন এ ঢুঁ মেরে দেখলে পেয়েও যেতে পারেন বাংলা বই। লাইব্রেরি গুলোতে কিন্তু প্রায়ই এটা সেটা লেগে থাকে, যেমন computer বা English Language courses ইত্যাদি। এছাড়া সেখানে সমমনা মহিলাদের দল বা গ্রুপস এর হদিস পাওয়া যায়, যেমন মাদার্স গ্রূপ, সাপোর্ট গ্রুপ etc .এদের কাছ থেকে আপনি পেয়ে যাবেন নানা ধরণের লাইফ স্কিলস, যেমন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার বিধি, বিভিন্ন সাহায্যকারী apps এর খবর, ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলার এবং পরিচালনার টিপস, এমনকি এটিএম মেশিন ব্যবহার করার নিয়ম কানুন। আপনারা অনেকেই হয়তো দেশে থাকতেই এগুলো করেছেন বা জানেন, কিন্তু একেবারে কখনো করেননি, এমন অনেকেও কিন্তু আসেন।

যিনি রান্না করতে ভালোবাসেন, তিনি সেটার জন্য নিজে দেখে শুনে বাজার করতে পারেন, এতেও আপনার social skills এবং language fluency বাড়বে। যিনি চাকরি করতে চান, তিনি আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে কোনো একটা কোর্স এ ভর্তি হতে পারেন, এবং সেখানকার কলেজ কাউন্সেলর কে বললে সেখান থেকেও কিছু সাহায্য , পরামর্শ পাবেন। সত্যি বলতে কি, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে প্রাথমিক ভাবে কাউন্সিলিং এর তুলনা হয় না, কারণ এরা শুধু যে মন ভালো রাখার পরামর্শ দেন, তা কিন্তু না। এরা নানারকম practical suggestions এবং referral দিয়ে আপনাকে নানারকম সুযোগ সুবিধে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করবেন।

মোট কথা, আপনার ভালো থাকার চাবি কাঠিটা কিন্তু আপনার হাতেই। সেটা খুঁজে পেতে হবে, সেটার যত্ন করতে হবে, এবং সেটাকে আরো শানিত করতে হবে। তা না করে আপনি যদি কেবলি উদ্বেগ আর বিষন্নতায় তলিয়ে যেতে থাকেন, কারো সাহায্য না নেন, কাউকে মনের কথা খুলে না বলেন, তাহলে কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না, তাই সবার আগে নিজেকে ভালোবাসুন, কারণ আপনি ভালো না থাকলে আপনার প্রিয়জনদের কিভাবে ভালো রাখবেন?

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category