‘নদীতে এ বছর কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ মাছ পাইনি। আড়তদার থেকে দাদন লইছি, পরে আবার সমিতি (এনজিও) থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিছি। আশা ছিল নদীতে বেশি মাছ পাইলে অভিযানের আগেই আড়তদারের দেনা দিমু। কিন্তু নদীতে মাছ না পাওয়ার কারণে দেনা শোধ করতে পারিনাই। তার ভিতরে আবার শুরু হইছে অভিযান। আড়তদাররা দেনা শোধ করতে চাপ না দিলেও এনজিওর লোকজন কিস্তির জন্য ঘর ছাড়বে না। আমাগোরে যদি চাউলটাও সঠিকভাবে দিত তাহলে আমরা কোনরকম খায়া বাঁচতে পারতাম। এহন সংসার সামলামু না দেনা দিমু’- দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ভোলার তুলাতুলি মাছ ঘাট এলাকার জেলে মো. কামাল।
শুধু কামাল নয়, তার মতো জেলার প্রায় ৩০ হাজার অনিবন্ধিত জেলের কপালে সংসার চালানো ও ঋণের কিস্তি পরিশোধে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
এমন পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞার সময়ে ঋণের কিস্তি বন্ধ ও অভিযানের প্রথম সপ্তাহে সরকারি খাদ্য সহায়তার দাবি জানিয়েছেন জেলেরা।
আজ মধ্যরাত থেকে ভোলার মেঘনা-তেতুঁলিয়ার ১৯০ কিলোমিটার এলাকা থাকছে ইলিশ শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞায়। এতে আগামী ২২ দিন কর্মহীন হয়ে পড়বেন ভোলার ৭ উপজেলার প্রায় ২ লক্ষাধিক জেলে। এদের মধ্যে সরকারিভাবে নিবন্ধিত জেলেরা সরকারি প্রণোদনা পেলেও অনিবন্ধিতরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ২ লাখের বেশি। এর মধ্যে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার। অথচ সরকারি প্রণোদনা হিসেবে ২৫ কেজি করে চাল এসেছে ১ লাখ ৪০ হাজার জেলের জন্য। এতে বাকিরা এ বছর সরকারি প্রণোদনার আওতামুক্ত থাকবেন। অন্যদিকে প্রতি বছর ৩০ হাজার অনিবন্ধিত জেলে থাকেন সরকারি প্রণোদনার বাইরে।
সরেজমিনে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা, নাছির মাঝি, ভেদুরিয়া পাকার মাথা, ভোলার খাল, তুলাতুলি, দৌলতখান পাতার খাল ও লালমোহন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নিষেধাজ্ঞা মেনে জেলে ও ট্রলার মালিকদের মাছ ধরার সরঞ্জামাদি তীরে উঠানোর চিত্র দেখা গেছে।
দৌলতখান উপজেলার পাতারখাল মাছঘাট এলাকার জেলে ছাবেদ মাঝি জানান, নদীতে মা ইলিশের ডিম ছাড়ার সুবিধার্থে সরকার ২২ দিনের অভিযান দিছে। আমরা সরকারের আইন মাইন্না (মেনে) জাল-সাভার (জাল-ট্রলার) তরে (তীরে) উঠাইছি। অভিযান শেষ না হইতে আর গাঙ্গে নামুম না (নামবো না)।
তিনি আরও জানান, অভিযানে আড়তদাররা দেনা শোধ করতে চাপ না দিলেও এনজিওর লোকজন কিস্তির জন্য ঘর ছাড়বে না। সরকারের কাছে দাবি জানাই অভিযানে সমিতির কিস্তি যেন বন্ধ করে। এতে কিছুটা নিশ্চিতে থাকতে পারব।
লালমোহন উপজেলার দেবীরচর এলাকার মাঝি কবির জানান, এই কয়দিন আমাগো কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কিস্তির টাকা আবার সংসারের খরচ এসব দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
ভোলার তুলাতুলি মৎস্যঘাটের আড়তদার মো. মঞ্জু জানান, এ বছরে এখনো লাভের মুখ দেখিনি। আজ মধ্যরাত থেকে অভিযান শুরু হবে। তাই আগামী ২২ দিনের জন্য আড়ত বন্ধ থাকবে। আড়ত বন্ধ করার প্রস্তুতি শেষ। অভিযান শেষ হলে ফের আড়ত চালু করবো।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বার্তা২৪.কম-কে জানান, অভিযান সফল করার লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যে স্টেকহোল্ডার যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও সচেতনতা সভা করেছি। এ বছর ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। অভিযানে কোনো নৌকা যেন নদীতে নামতে না পারে সে জন্য সব খালের মধ্যে মাছ ধরা নৌকা ঢুকিয়ে খালের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আমাদের অভিযান সফল করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এ বছর আমাদের উদ্দেশ্য জেল-জরিমানা না, শুধু নদী জেলে মুক্ত রাখা। যেন মা ইলিশ নির্বিঘ্নে নদীতে প্রজনন করতে পারে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, এ বছর ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯০০ জেলের জন্য সরকারি প্রণোদনার চাল পেয়েছি। এতে ভোলার ৭ উপজেলার জেলেদের আমরা অভিযানের প্রথম সপ্তাহে ২৫ কেজি করে চাল দিতে পারবো।
অসাধু মৎস্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বছর যদি কেউ তার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইলে প্রমাণ পাওয়া মাত্র তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আজ মধ্যরাত থেকে ভোলার মেঘনা-তেতুলিয়া ইলিশ স্বীকার বন্ধসহ ২২ দিন সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। আমরা এ বিষয়ে সব ব্যবস্থা নিয়েছি। নদী পাড়ে মোবাইল কোর্টসহ নদীতে বিশেষ পাহারা থাকবে।
উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মা ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে আজ শনিবার (১২ অক্টোবর) রাত ১২টা থেকে শুরু হয়ে ৩ নভেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত মোট ২২ দিন ইলিশ শিকার, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ, পরিবহণ, ও বিনিময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
Leave a Reply