চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য্য।
ঘন অন্ধকারের মত এক ঢাল চুল নিয়ে দেশী বিদেশী সব ভাষাতেই রচিত হয়েছে গান কাব্য উপন্যাস রূপকথার গল্প সিনেমা বিজ্ঞাপন আরো কত কিছু এই চুল নিয়ে।
বাংলার মেয়েরা যেমন বনলতা সেন হতে চায় তেমনি ইংলিশ মেয়েরা হতে চায় রপাঞ্জেল হতে আবার আরবী মেয়েরা হতে চায় জেসমীন।আসলে শুধু বাংলা ইংলিশ বা আরবীয়ই নয় সব মেয়েরাই চায় ঘন কালো মসৃন মাথা ভরা চুল।
গঠন ও গুনাগুন অনুসারে মানুষের প্রধানত ৪ ধরনের চুল হয়ে থাকে। যথা- সোজা চুল, ঢেউখেলানো চুল, কোঁকড়া চুল ও কোমল চুল। চুলের ধরন যেমনই হোক না কেন সৌন্দর্য ঠিক রাখতে ও চুল মসৃন রাখতে চুলের যত্ন নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একটা সময় ছিল লম্বা চুল রাখাটা সহজ হতো কারন বাড়ির মেয়েদের এত বাইরে যাওয়ার ব্যপার ছিল না।ঘরে বসেই তারা নানান উপায়ে চুলের যত্ন নিতেন ।লম্বা চুলের সৌন্দর্য্য বজায় রাখতে পারতেন।বাইরের শীত গ্রীষ্ম রোদ বৃষ্টি ধুলো কিছুতেই তাদের চুলের তেমন ক্ষতি হতো না।
আর বর্তমান ব্যস্ত সময়ে পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে নারীরাও প্রতিদিন প্রতিটা কাজ করছে নিজের হাতে কি হাটে কি মাঠে সর্বত্রই তাদের দৌড়াতে হয়।তাই এই ব্যস্ততায় ঘন লম্বা চুল রাখা এবং তার যত্নের জন্য আলাদা করে সময় বের করা সত্যিই মুসকিলের বিষয়।
তবে চুল লম্বা বা খাঁটো, ঘন বা পাতলা সোজা বা কোঁকড়ানো যেমনই হোক না কেন প্রতিটি রকমের চুলের জন্য চাই কিছুটা হলেও যত্ন।
ছোটবেলায় একটা প্রবাদ বলতেন আমার দিদিমা তা হলো “ নখাইলে কেশ, আঁচড়াইলে বেশ”
তার মানে হলো চুলে আঙ্গুল দিয়ে মেসেজ করলে চুল হয় সুন্দর আর চিরুনি দিয়ে আচড়িয়ে নিলে তা হয় দেখতে সুন্দর।
তিনি আরো একটি প্রবাদ বলতেন,”জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা”
এর অর্থ হলো- চুন ভালো থাকে তাতে জল দিলে আর চুল ভালো থাকে তাতে তেল দিলে।
বংশগত ভাবেও কারো কারো চুল খুব সুন্দর হয় আবার কারো চুল হয় যত্নে সুন্দর।
চুলের যত্নের আগেই জানা উচিত চুল নিয়ে সমস্যা গুলো কি কি- চুলের সমস্যা যেমন খুশকি, চুল পড়া, চুলের আগে ফেটে যাওয়া, চুলের কমনীয়তা হারিয়ে রুক্ষ হয়ে যাওয়া,বেশি তৈলাক্ত চুল, চুলের রং বদলে যাওয়া, কম বয়সেই চুল পেকে যাওয়া ইত্যাদি।
মোটামুটি সবাই কম বেশি এই সব সমস্যার সমুক্ষীন হন।আর এই সব সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তি না পেলেও এর কিছু সমাধান অবশ্যই আছে।
চুল একটা বাহ্যিক সৌন্দর্য্য হলেও এর যত্ন শুরু করতে হয় দেহের ভিতর থেকে।শরীরের আভ্যন্তরীন স্বাস্থ্য ভালো রাখলেই অনেকাংশে চুলও ভালো থাকে……
১.পুষ্টিকর খাবার ও পানীয়ঃ
আপনি সুস্থ থাকলে ভাল থাকবে চুল। তাই সুন্দর চুল রাখতে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া আবশ্যক।দামী খাবার নয় পুষ্টিকর খাবার যাতে থাকবে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন, আয়রন এবং প্রোটিন।ডিম দুধ খাদ্য তালিকায় থাকলে চুলের জন্য খুব ভালো।আর এইসব খাবার আপনার চুলের বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ন।সেই সাথে প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে জল এবং পানীয় পান করতে হবে।পানীয় বলতে ডাবের জল, লেবু মধুর সরবত, সিজনাল ফলের রস ইত্যাদি।
২.চুল সব সময় খোলা না রাখাঃ
হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে যার অর্থ এমন যে রোদে চুল পাকেনি- যদিও ভিন্ন অর্থে কিন্তু এখানে মূল কথাটা হলো যে রোদে চুলের ক্ষতি হয়, ক্ষতি হয় ঝড়ো বাতাসে, ধুলোবালিতে, বৃষ্টির জলে। এই সব খোলা চুলে বেশি বিপত্তি বাঁধায়।তাই চুলকে সুরক্ষিত রাখতে হলে দৈনন্দিন জীবনে বাইরে বের হবার সময় চুলকে বেঁধে রাখাই উত্তম।
৩. চুলে তেল দিন নিয়মিত/সপ্তাহে চুলে গরম তেলের ব্যবহারঃ
নিয়মিত তেল ব্যবহারে চুলের জন্য ভীষন উপকারী।তেল চুলের পুস্টি জোগায়, চুলের চুলের গোড়া মজবুত হয়।চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ে।সপ্তাহে একদিন যদি তেল গরম করে চুলে দেয়া যায় এবং হালকা মেসেজ নেয়া যায় এটা চুলের পরিপূর্ণ পুষ্টি যোগাতে সাহায্য করে।নারকোল তেল ছাড়াও বাজারে তিলের তেল, আমলা অয়েল, আমন্ড অয়েল, অলিভ অয়েল, ক্যাস্টর অয়েল ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়।
চাইলে এগুলো একসাথে মিক্স করেও চুলে লাগাতে পারেন।একদম খাঁটি শরিষার তেল ও কিন্তু চুলের জন্য ভালো।ঘরে তৈরী মিক্স অয়েল ও ভালো।
তেল লাগানোর পর পরই আসে শ্যাম্পুর কথা-
৪. সঠিকভাবে চুলের ধরন বুঝে শ্যাম্পু করুনঃ
বাইরে বের হলে চুলে প্রচুর ধুলোবালি আর ময়লা চুলে জমে থাকে। এমনকি ঘামেও চুলে ময়লা এবং দূর্গন্ধ হয় তাই, চুল পরিষ্কারের জন্য চুলের ধরন বুঝে ভালো মানের শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করুন ।শ্যাম্পু করার সময় ভালো করে পুরা চুলে মাখিয়ে শ্যাম্পু করতে হবে। এবং পর পর দুই বার চুলে শ্যাম্পু করুন।
যারা প্রতিদিন বাইরে বের হোন তাদের সপ্তাহে ৩/৪ দিন শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
৫. কন্ডিশনার ব্যবহার করুনঃ
প্রতিবার চুল ধোঁয়ার পর চুলে কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। এতে চুল হয় মসৃন ফলে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায়। কন্ডিশনার ব্যবহার করুন তবে সঠিকভাবে। কন্ডিশনারের কাজই হলো চুলকে মসৃন রাখা যার মানে হলো চুলের গোড়াতে এর কোনো প্রয়োজনই নেই।
তাই কন্ডিশনার ব্যবহার করার সময় তা প্রয়োগ করা উচিত চুলের গোড়া থেকে অন্তত এক ইঞ্চি দূর থেকে।
এছাড়া অতিরিক্ত পরিমানে কন্ডিশনার ব্যবহার করা থেকেও বিরত থাকা উচিত নাহলে চুল তৈলাক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।
তবে যাদের সময় কম তারা শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার মিশ্রিত শ্যাম্পু ও ব্যবহার করতে পারেন।
৬. চুলের যত্নে ঠান্ডা জলঃ
গরম জলে চুল ধোয়া চুলের জন্য ক্ষতিকর, তাই চুল পরিষ্কারের জন্য সবসময় ঠান্ডা জল ব্যবহার করুন।আজকাল সব বাড়িতেই গীজার থাকার কারনে খুব সহজেই গরম জল পাওয়া যায়।তাই স্নান করার সময় গরম জলটা যদিও আরামদায়ক তবে চুলের জন্য ক্ষতিকর।এতে চুল রুক্ষ হয়ে পরে, চুলের গোঁড়া নরম হয় এবং সবচেয়ে বেশি যা হয় তা হলো খুব দ্রুত চুল পাকতে শুরু করে।তাই গরম কালে তো অবশ্যই এমনকি শীতকালেও চুলে গরম জল ব্যবহার করা উচিত নয়।
৭. পরিস্কার তোয়ালে ব্যবহার করুন নরম হাতেঃ
অনেকেই চুলকে মোছার সময় খুব চাপ প্রয়োগ করে চুল মুছে থাকে। এতে বারবার ঘর্ষণের ফলে চুল তার সুস্থতা হারিয়ে ফেলে।আর চুল ভেঙে যাওয়ার আশংকা থাকে।তাই চুল মোছার সময় যতটা সম্ভব আলতোভাবে নরম হাতে তোয়ালে ব্যবহার করা উচিত।এবং পরিস্কার তোয়ালে ব্যবহার করা উচিত।প্রতিদিনের জন্য ভারী তোয়ালে ব্যবহার না করে পাতলা গামছাও ব্যবহার করা যায়।যা প্রতিদিন ধোয়া ও শুকানের ঝামেলা কম।
৮. ভেজা চুল সাবধানে সামলানঃ
ভেজা চুল সবথেকে ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। ভেজা অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে চুলের গোড়া নরম থাকে এবং চুল ভেঙে যাওয়া সবচেয়ে সহজ তাই শ্যাম্পু করার সময় চুলে বেশি চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়।
এছাড়াও গোসলের পরপরই চুলে চিরুনি ব্যবহার করা উচিত নয়।কারন এই সময় সহজেই চুল ছিড়ে যেতে পারে।
৯. হেয়ার ড্রায়ার ও নানারকম হট হেয়ার স্টাইলার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুনঃ
উচ্চ তাপ চুলকে ভেঙে যেতে সহায়তা করে আর তাই চুলে হিট দেওয়া থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
অতিরিক্ত হিটের কারণে চুল জ্বলে যেতেও পারে তাই হেয়ারড্রায়ার, ব্লোয়ার, কার্লার, আয়রন অথবা চুল স্ট্রেটনার যদি ব্যবহার করতেই হয় তাহলে সাবধানতার সাথে তা করা উচিত।
১০. চুল নিয়মিত আচড়ানোঃ
চুল ভালো করে শুকিয়ে গেলে নিয়মিত চিরুনি বা ব্রাশ দিয়ে আচড়ানো প্রয়োজন। এতে চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং চুলের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
প্রতিদিন দিনে ২-৩ বার চুল আচড়ানো চুলের জন্য উপকারী, রাতে ঘুমানোর চুল খোলা না রেখে চুল ভালো ভাবে আচড়ে নিয়ে হলকা বেনী করে নিলে বালিশের সাথে চুল ঘসা খাবে না এবং চুল ভালো থাকবে।
১১. ভালো বালিশের কভার ব্যবহার করুন
সিনেথেটিক কাপড় নয় পাতলা সূতি কাপড়ের তৈরী বালিশের কভারে ঘুমালে চুল ভালো থাকবে।আমাদের ছোটবেলায় আমরা বালিশের উপর পাতলা তোয়ালে ব্যবহার করতাম যা বালিশ এবং চুল দুইয়ের ক্ষেত্রেই উপকারী।মাথার ঘাম, তেল এইসব বালিশে লেগে নানা রকম ব্যাকটেরিয়ার সৃস্টি হয় যা চুলের জন্য ক্ষতিরক।
আবার প্রতিদিন বালিশের কভার বদলানো সম্ভব না ।তাই পাতলা কাপড়ের তোয়ালে ব্যবহার করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
১২. চুলের জন্য বিশেষ খাবারঃ
এখন তো অনেক সুবিধা! বাজারে নানারকম হেয়ার কেয়ার প্যাক পাওয়া যায়।চুল ভালো রাখার জন্য এবং চুলের ধরন বুঝে হেয়ার প্যাক ব্যবহার করুন। চুল শুষ্ক বা মিশ্র হলে ১০ থেকে ১৫ দিন পরপর, আর তৈলাক্ত হলে ১৫ দিন পরপর চুলে প্যাক লাগান।
ঘরে তৈরী প্যাক চুলের সুরক্ষায় বেশি কার্যকরী ।চুলের যত্নে আদিকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়েছে নানারকম তেল, মেহেদি, রীঠা, ডিম, মেথী, আমলকি, লেবু, দই, কারিপাতা, এ্যালোভেরা ইত্যাদি।এইসব নিয়ম করে ব্যবহার করলে চুলের উপকার নিশ্চিত।
১৩. ক্যামিকেল মিশ্রিত হেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার কম করা উচিতঃ
সুন্দর চুলের জন্য যে খুব ব্যয়বহুল দামি জিনিষ ব্যবহার করতে হয় এমনটা কখনই নয়।আপনার হাতের কাছে ছড়িয়ে থাকা জিনিষের ব্যবহারই পারে আপনার চুলকে ঝলমলে করে তুলতে।
তাই চুলে অতিরিক্ত হেয়ার প্রোডাক্ট কখনই ব্যবহার করা উচিত নয়। এইসব রংচংয়ের মোড়কে থাকে চুলের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যা গন্ধে ও সৌন্দর্য্যে অতুলনীয় হলেও এতে চুলের বৃদ্ধি এবং সৌন্দর্য বাড়াতে সহায়তার পরিবর্তে ক্ষতিকারকই বেশি।
আপনার চুলের যত্ন প্রতিদিন অল্প করে হলেও নিতে হবে।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটু একটু করে সময় বের করে এর যত্ন নেয়া খুব জরুরি। এতে চুল ভালো থাকে এবং চুলের যত্ন নেওয়ার জন্য যেসব হেয়ার প্যাক বা হেয়ার মাস্কগুলো আপনি ব্যবহার করেন সেগুলো ভালো করে কাজে দিবে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণের পানি এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এবং নিয়ম করে প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একদিন যত্ন নিতে হবে।
“কেশ হইলো অর্ধেক বেশ”
যার এক মাথা ঝলমলে চুল আছে তার পুরোটা সৌন্দর্য্যের অর্ধেকটাই চুলের জন্য হয়েছে।তাই চুলের যত্ন নিন, ঝলমলে সৌন্দর্য্যে আপনিও থাকুন উজ্জ্বল।
Leave a Reply