যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে (যুদ্ধকালীন বা প্যানডেমিক সময়সহ) সাংবাদিকদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত?
বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং গনমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পিটার গ্রেস্টি (প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, এ্যালাইন্স ফর জার্নালিস্টস’ ফ্রিডম) মনে করেন একজন দক্ষ এবং কার্যকর সাংবাদিকের মধ্যে সন্দেহপ্রবনতা এবং স্বাধীনতাপ্রিয়তা থাকা প্রয়োজন।
মাঝে মাঝে গভীর দু:খজনক পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে কেনো কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক সংগঠনকে স্বাধীনভাবে এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে হয়।
যখন আমরা বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি তখন এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুভূত হয়েছে যে আমাদের তথ্যসমৃদ্ধ, প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন গনমাধ্যম রয়েছে কি-না এবং গনমাধ্যমগুলো পেশাদারিত্ব এবং বিশুদ্ধতার সাথে কাজ করছে কি-না।
মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটি দুর্যোগে সংগতিপূর্ণ এবং বিশুদ্ধ তথ্য যেমন মানুষের জীবন বাঁচায় তেমন দুর্যোগের ঘনত্ব কমায়।
এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে একটি সত্য এবং ভালো তথ্যের সরবরাহ জ্বলন্ত শিখা নিভিয়ে দিতে পারে, অচেতন মৃতপ্রায় মানুষের চেতনা ফিরিয়ে দিতে পারে। শুধু তাই নয় বিশুদ্ধ এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সাধারন মানুষের জন্য দুর্যোগ থেকে বেড় করে আনার পথ বাতলে দেয়। মানুষের জীবন রক্ষায় কৌশল গ্রহনের দিকনির্দেষনা দেয়। শুধু তা’ই নয় অবাধ তথ্য আমাদেরকে সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বিশেষজ্ঞগনের মতামত এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় অভিজ্ঞদের অভিজ্ঞতা পেতে সাহায্য করে। অবাধ তথ্যের সরবরাহ দুর্যোগ মুহূর্তে দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি দায়িত্ববান এবং জবাবদিহিতামূলক সরকারের গৃহীত সকল কর্মসূচী জানতে সাহায্য করে।
কিন্তু তথ্যের বিশুদ্ধতা নিয়ে সাধারনে অবিশ্বাস থাকলে, তথ্যের উৎপত্তিস্থল স্বাধীন না হলে সরবরাহকৃত তথ্য তো কাজে আসবেইনা বরং দুর্যোগের মাত্রা বহুগুনে বাড়িয়ে দেবে।
স্বৈরশাসন, বা দূর্বল বা সীমিত গনতান্ত্রিক শাসনে সাংবাদিকগন সংবাদের সত্যতা নিয়ে সন্দেহপ্রবনতা থেকে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকেন বা থাকতে বাধ্য হোন। এবং সংবাদতথ্য যাচাই করার জন্য সরকারের নির্দিষ্ট ব্যক্তির পিছনে লাইন ধরতে হয়। বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সরবরাহকৃত তথ্য মাঠে বিরাজমান পরিস্থিতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। তখন মানুষ আর সরকারের সরবরাহকৃত তথ্যে বিশ্বাস স্থাপন করেনা। তখন সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় ক্রমশ: ক্ষমতা হারায় বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
যখন কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকগনকে দেশপ্রেমিক হয়ে তাঁদের বানী প্রচারে আহ্বান জানান তখন সাংবাদিক আর সাংবাদিক থাকেননা। সাংবাদিক তখন সরকার বা সরকার প্রধানের প্রপাগান্ডা প্রচারের মাইকে পরিনত হোন। সাংবাদিকগন তখন সরকারের অনুগত হয়ে যান। আর তখনই জনগন সামাজিক মাধ্যমকে বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং মূলধারার সংবাদপত্র তখন গৌন হয়ে যায়।
অর্থবহ কার্যকর সাংবাদিকতা মানেই তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে সন্দেহপ্রবনতা থাকতে হবে, তথ্যের উৎস কতোটা স্বাধীন তা’ নিশ্চিত করতে হবে। গনতান্ত্রিক সমাজে সাংবাদিকের দায়িত্ব হচ্ছে নীতি এবং নৈতিকতা কাজ করছে কি-না তা’ নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা।
ইউকে বেইজড্ First Draft News, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত তথ্য পরিবেশনে সাংবদিকতার নীতি-নৈতিকতা মেনে রিপোর্টিং করার জন্য নিম্নলিখিত নির্দেশনা প্রকাশিত করেছিলোঃ
– ভীতির সন্চার করে এমন স্পর্শকাতর ভাষা পরিহার করা উচিত;
– এমন কোনো ছবি প্রকাশিত করা উচিত নয় যা’ মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করে;
– তথ্যপ্রকাশের পূর্বে একাধিক বিশেষজ্ঞের সাথে মিলিয়ে নেয়া;
– মনে রাখতে হবে সকল গুজব কভারেজ পায়না।
উপরোক্ত নির্দেশনা শুধু দুর্যোগ সময়কালীন কার্যকর তা’ নয়; সব সময়ই প্রয়োজন হয়।
বর্তমান দুর্যোগ মুহূর্তে অন্য সকল সময়ের থেকে গনমাধ্যম বেঁচে থাকার লড়াই করছে। ডিজিটাল বিপ্লবও গনমাধ্যমকে চ্যালেন্জের সম্মুখীন করেছে। গুগল, ফেইসবুক বিজ্ঞাপন রেভিনিউ’র সিংহভাগ দখল করে নিয়েছে। আর্থিক সংকট সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
দুর্যোগ মুহূর্তে সাংবাদিক ইনস্টিটিউশনগুলোর সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে কার্যকরভাবে সাংবাদিকতা করা উচিত। সাংবাদিকগন দুর্যোগব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অংশ। সাংবাদিকদের স্বাধীন এবং মুক্তভাবে কিন্তু দায়িত্ববোধের সাথে এই মুহূর্তে কাজ করতে হবে।
Leave a Reply