প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতবর্ষে চায়ের বিপণন ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। ক্রেতাদের চামুখী করার জন্য কোম্পানিগুলোর নানামুখী তৎপরতা ছিল উল্লেখ করার মতো। তারা এ কাজে বাহারি বিজ্ঞাপন ছাড়াও নানাবিধ বিনিয়োগের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মানুষদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করত। তবে শুরুতে চরম প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাদের। বৈরী এ পরিবেশ তৈরিতে সর্বতো সহযোগিতা ছিল যার, তিনি হলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ ও দার্শনিক প্রফুল্লচন্দ্র রায়। স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় চা পানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার প্রয়াস পান। সেকালের চায়ের বিপণন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষার্থীদিগকে বিনা মূল্যে চা পান করাইবার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রে কেন্দ্রে তাঁবু ফেলা হইতে লাগিল। একজন ‘টি কমিশনার’ এতদর্থে নিযুক্ত হইলেন। ‘টি কমিশনার’ সুলভ মূল্য নহে, একবারে বিনা মূল্যে জনসাধারণকে ‘চা-খোর’ করিতে লাগিলেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৩৭টি সহরে চা-খানা স্থাপিত হইয়াছিল। বৎসরের শেষে উহা ৬৮৩টিতে পরিণত হয়।’ মাসিক বসুমতী পত্রিকার ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ভাদ্র ও কার্তিক সংখ্যায় তিনি ‘চা-পান ও দেশের সর্ব্বনাশ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেন। ইতঃপূর্বে একই পত্রিকায় তিনি লিখেন, ‘চা-পান না বিষ-পান’ শীর্ষক প্রবন্ধ। তার মতে, চা মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে এবং ক্ষুধা নষ্ট করে। নিজের ধারণার সপক্ষে তিনি একটি ব্যঙ্গচিত্রও আঁকেন। এ ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, একজন ‘পাক্কা চা-খোর’ এর করুণ চিত্র। এ পাক্কা চা-খোরের টেবিলে একটি বড় চায়ের পাত্র আর তার হাতে এক কাপ চা। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পায়ে ছিন্ন জুতা, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, আর চারদিকে ছড়ানো অসংখ্য সিগারেটের খোসা। সব মিলিয়ে চায়ের নেশায় অকেজো এক মানুষের প্রতিচ্ছবি। ‘চা-পান ও দেশের সর্ব্বনাশ’ প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন- ‘চা পান করিলে জাতিনাশ হইবে, এমন কথা আমি বলি না। পরিমিত চা পানে দেহের স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইবে, এমন কথাও আমি বলিতেছি না। আমার বলিবার কথা এই যে, যদি বাঙালি সংযম ও নিয়মের অনুজ্ঞা মানিয়া প্রচুর সারবান ও পুষ্টিকর খাদ্যের সহিত সামান্য একটু চা দিবাভাগে একবার মাত্র পান করে, তাহা হইলে বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু বাঙালি অপরিমিত চা পান করিতে অভ্যস্ত হইয়া আপনার সর্ব্বনাশ সাধন করিতেছে, ইহাই দেখাইয়া আমি সময় থাকিতে বাঙালীকে সতর্ক হইতে বলিতেছি।’ চা চাষের ফলে বাঙালি অর্থনীতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেসব কথাও তিনি তার লেখায় তুলে ধরেন। ফলে বাঙালিদের অনেকেই তখন চা-পানের বিরোধিতা করে। ব্রাহ্মসমাজের অনুগামীরা প্রায় সবাই চা পানের আসক্তির ঘোরবিরোধী ছিলেন।
Leave a Reply