নয়নতারার সাথে পরিচয় ছোটবেলায়।গ্রামে দাদুর বাড়ি থেকে শুরু করে মাসির বাড়ি, কলকাতা টু সিডনি সব জায়গায় এর ঝলমলে পদচারনা হলেও এর কদর শুধু পূজার সহজলভ্য ফুল হিসেবেই দেখেছি।আলাদা করে এর যত্ন কেউ করে বলে দেখিনি।কিন্তু কোনো যত্ন ছাড়াই বাড়ির আশেপাশে, বাগানের কোণে, অবহেলিত ভাবে বেড়ে ওঠা নয়নতারা গাছটি আসলে একটি জীবনদায়ী ভেষজ উদ্ভিদ। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এর গুণাবলী অপার। যদি নিয়ম করে এই ভেষজ গাছটির ঔষধী গুন গুলো প্রতিদিন ব্যবহার করা যায় তাহলে জীবন হবে রোগ মুক্ত ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল।তাই আজই বাগানে অথবা টবে লাগান নয়নতারা ফুলের গাছ।আর জেনে নিন এর উপকারিতা ।
প্রথমেই নয়নতারার আদি নিবাস, কোথায় কোথায় এর বাস এবং এর রং ধরন প্রকৃতি সম্পর্কে একটু ধারনা দেয়া যাক।ধারনা করা হয় নয়নতারার জন্ম মাদাগাস্কারে তবে তা ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকা সহ আরো নানা দেশে।এটি একটি বর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ হলেও জাত ভেদে এরা বহু বছর বাঁচে।আকারে ছোটো অর্থাৎ ২/৩ ফুটের বেশী লম্বা হয়না এই গাছ।পাতা ডিম্বাকৃতি এবং ঘন সবুজ রঙের আর ফুলের রং বেগুনি গোলাপীর মাঝামাঝি একটা রঙের হলেও বর্তমান সময়ে এবং দেশের বিভিন্নতায় এখন নয়নতারা পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি রঙের ।যেমন সাদা, সাদার ভেতর গোলাপী বিন্দু, হালকা গোলাপী, কড়া গোলাপী, লাল, বেগুনি,প্রতিটি রংঙের ফুলের মাঝখানে ভিন্ন ভিন্ন রঙের বিন্দু যেন একটি ফুল থেকে আরেকটিকে আলাদা পরিচয় দেয়।এত সুন্দর রঙ আর গড়ন হলেও এর কোনো গন্ধ নেই।পাঁচ পাপড়ি আর লম্বা দলনলের এই ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Catharanthus roseus, এটি Apocynaceae (dogbane, অথবা oleander পরিবার) পরিবারের একটি উদ্ভিদ। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামেও পরিচিত, যেমন Cape periwinkle, Madagascar periwinkle, periwinkle, sadabahar, sadaphuli, sadasuhagi, sadsuhagan ইত্যাদি। এর আরেকটি প্রজাতি হলো Vinca rosea।খুব অল্প যত্নেই বেড়ে ওঠে নয়নতারা ।একটু রোদ আর একটু জল পেলেই ফুল ফোঁটায় সারা বছর ধরে।
এবার জেনে নেই এর উপকারিতা সম্পর্কেঃ
গাছটির ফুল পাতা ও ডালে বহু মূল্যবান রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায় বলেই এই গাছটির ভেষজ গুন অনেক এবং বিভিন্ন রোগে এর ঔষধী গুনের জন্য ব্যবহৃত হয়।যেমন বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ, ক্রিমি রোগে, চর্ম রোগ ও রূপচর্চায়, মেধাবৃদ্ধিতে, অনিয়মিত ঋতুশ্রাব ও লিউকোরিয়ায়, দুশ্চিন্তা উদ্বেগ ও মানসিক চাপ কমানো সহ নানা রোগে এর ব্যবহার রয়েছে। মৌমাছি বা বিষযুক্ত কীট পতঙ্গের দংশনে দ্রুত উপশম পেতে নয়নতারা ফুল বা পাতার রস ব্যবহারের প্রচলন বহু আগে থেকেই ছিল।গ্রামাঞ্চলে এর ব্যবহার বেশী হয়।
বহুমূত্রঃ বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পেতে নয়নতারা ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম। নয়ন তারা গাছের ফুল ও মূল, শুকনো হলে ১ গ্রাম আর কাঁচা হলে ২ গ্রাম এক সঙ্গে করে মাঝারি মাপের ১ কাপ জলে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে জলটা ছেঁকে ফুটিয়ে অর্ধেক কাপ করে নিন। এবার ওই জল অর্ধেক করে সকাল ও রাতে পান করুন। দিন দশেক ব্যবহারের পর পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কয়েক দিনের মধ্যেই ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং অন্যান্য উপসর্গ গুলিও কমে গিয়ে নিয়ন্ত্রণে আসবে ডায়াবেটিস অসুখ ।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতেঃ ১০/১২ টি নয়নতারা পাতা বেটে তার থেকে রস বের করে নিন। সকালে বা রাতে শুতে যাওয়ার আগে সেই রস নিয়মিত পান করুন। এতে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
কৃমি কমাতেঃ দুই গ্রাম কাঁচা, আর যদি শুকনো হয় তাহলে এক গ্রাম পরিমানের নয়নতারা গাছের ফুল, মূল ও পাতাা একসঙ্গে এক কাপ জলে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে সেই জলটা ছেঁকে ফুটিয়ে অর্ধেক করে নিন। এরপর ওই জলটা দু’ভাগে ভাগ করে সকালে এবং রাতে ৮ থেকে ১০ দিন পান করলে কৃমির সমস্যা চলে যায়। এটি ছোটদের দেবেন না। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
চর্ম রোগ ও রূপচর্চায়ঃ নয়নতারার পাতা বেটে তার রস দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করলে চুলকানি এবং ফাঙ্গাস জনিত সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়া যায়। পাতা সেদ্ধ করা জল ব্যবহারে ত্বক হবে উজ্জ্বল ও তরতাজা। নয়নতারার পাতার সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে বেটে ফেস প্যাক তৈরি করে মুখে লাগালে ত্বকের জেল্লা বাড়বে রাতারাতি।
মেধা বৃদ্ধিতেঃ এই ছোট ফুল নয়নতারা আসলে একটা ব্রেনটনিকের মত। নয়নতারার ফুল, মূল ও পাতা ২ গ্রাম পরিমানে ১ কাপ জলে সিদ্ধ করে নিন। জলটুকু ছেঁকে তা ফুটিয়ে আধা কাপ করে নিন। এবার সেই জল অর্ধেক করে ভাগ করে সকাল-বিকাল টানা ১ মাস পান করলে স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পাবে।
অনিয়মিত ঋতুস্রাব ও লিউকোরিয়ায় ব্যবহারঃ যাদের অনিয়মিত পিরিয়েডের সমস্যা বা মাসে একাধিক বার পিরিয়েডের যন্ত্রনায় ভোগেন, অধিক স্রাব, পিরিয়েড মারাত্মক যন্ত্রণা হয় তারা এইসব থেকে মুক্তি পেতে ব্যবহার করতে পারেন নয়নতারা।এছাড়াও লিউকোরিয়ার মতো অসুখ থেকে মিলবে মুক্তি।যদি নয়নতারার ফুল, মূল ও পাতা ২ গ্রাম পরিমানে ১ কাপ জলে সিদ্ধ করে নিন। জলটুকু ছেঁকে তা ফুটিয়ে আধা কাপ করে নিয়ে সেই আধাকাপ ক্বাথটি সকাল-বিকাল টানা ১ মাস পান করলে সমস্যা দূর হবে।
দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ কমাতেঃ এখনকার সময়ে এই তিনটি শব্দের সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষ কমই মিলবে।প্রতিদিনের জীবন যাত্রাঁয় হাজারো কাজের চাপ থেকে তৈরি হয় উত্তেজনা আতংক অবসাদ, মানুষ হয় দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত, ভুলে যাওয়ার সমস্যা, ঘুম না হওয়া ইত্যাদি। আর এই সব চক্করে শরীরে দানা বাঁধে এই সব রোগ আর এই ছোট ছোট রোগ গুলোই একটা সময় পরে ডিমেনশিয়া আলঝাইমার হাইপার টেনশনের মত মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হয়।একমুঠো শুকনো নয়নতারা ফুল ও পাতা জলে ফুটিয়ে নিয়ে চায়ের মতো করে তৈরি করুন। এর পর সেটা ছেঁকে এক চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক কাপ করে খান। খুব তাড়াতাড়ি ফল পাবেন।
পোকার দংশনে এন্টিসেপটিক হিসাবেঃ মৌমাছি,বোলতা, ভীমরুল, পিপঁড়া প্রভৃতির হুলের জ্বালার ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে নয়নতারার পাতা থেঁতো করে সেই রস বা পাতা বাটা লাগাতে হবে।
দৃষ্টি শক্তি বাড়ানো, বাতের ব্যথা, রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করা সহ প্রচুর সমস্যা সমাধান হয় এই ভেষজ গাছটির দ্বারা।
এছাড়াও ক্যানসারের মতো রোগেও নয়নতারা অসাধারণ কাজ করে বলে জানা যায়।। তবে যারা নিয়মিত চিকিৎসাধীন আছেন ।যাদের হৃদরোগ,কিডনি রোগ, লিভার এবং পেটের রোগ রয়েছে তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তবেই নয়নতারা ব্যবহার করবেন।
এত গুন সম্পন্ন নয়নতারা গাছ টবে বা বাগানে লাগিয়ে রাখুন এবং খুব সহজেই বাগানের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে, মনের প্রশান্তিতে ও নানারকম রোগ দূর করতে নয়নতারা ব্যবহার করুন ।
Leave a Reply