টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে ফেনী। বন্যার পানিতে ডুবে জেলার গৃহপালিত ও খামারের গরু-ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হাঁস-মুরগিসহ প্রায় ২৪ লাখ ১২ হাজার ৩৯৬টি পশু-পাখি মারা গেছে। যার মধ্যে হাঁস-মুরগি মারা গেছে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার ৯৮২টি, গরু-ছাগল, মহিষ-ভেড়া মারা গেছে ৫৫ হাজার ৪১৪টি।
প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকা বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়।
এছাড়াও বন্যায় প্লাবিত হয়েছে শত শত একর চারণভূমি। পানিতে তলিয়ে বিনষ্ট হয়েছে পশুপাখির দানাদার খাদ্য-ঘাস, খড়। এ অবস্থায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন জেলার কৃষক ও খামারিরা। বন্যার পানি থেকে বাঁচতে খামারি ও কৃষকরা আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও অনেকে নিয়ে যেতে পারেননি তাদের গৃহপালিত পশু ও হাঁস-মুরগি। ফলে ভয়াবহ বন্যায় মারা গেছে অধিকাংশ পশু-পাখি।
জেলা প্রাণিসম্পদ দফতর জানায়, এবারের বন্যায় প্রাণিসম্পদ খাতে এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। জেলার ছয় উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩৮ হাজার ৭৩১টি গরু, ৩৫৯টি মহিষ, ১৫ হাজার ৫৮৮টি ছাগল ও ৭৩৬টি ভেড়াসহ সর্বমোট ৫৫ হাজার ৪১৪টি পশু মারা গেছে। এছাড়াও ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১০টি মুরগি ও ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২টি হাঁসসহ সর্বমোট ২৩ লাখ ৫৬ হাজার ৯৮২টি হাঁস-মুরগি মারা গেছে। মৃত পশুপাখির মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৮ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩০ টাকা।
ফেনীতে বন্যার পানিতে তলিয়ে ছিল ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। একই সূত্র জানায়, জেলায় ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬৩টি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। ১ হাজার ৯৯২টি গবাদিপশুর খামারের ১৩ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা এবং ১ হাজার ৬২৩টি হাঁস-মুরগির খামারের ১০ কোটি ৯৭ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও ৩ হাজার ৯৫০ টন পশুপাখির দানাদার খাবার বিনষ্ট হয়েছে। যার বাজারমূল্য ২৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জেলায় ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার খড়, ৩ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকার পশুপাখির ঘাস বিনষ্ট হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ২৮৫ একর চারণভূমি।
ফেনীর নিজকুঞ্জরা গ্রামের খামারি শাখাওয়াত হোসেন বলেন, কিছুদিন পরেই মুরগি বিক্রির কথা ছিল। রাতের মধ্যেই পানি ঢুকে পড়ে, কোনো কিছুই সরাতে পারিনি। আড়াই হাজার মুরগি, সঙ্গে খাবারসহ অন্যান্য সব জিনিসপত্র পানিতে ভেসে গেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব না। এখন যদি স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে অনেকে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
ফুলগাজীর মোবারক হোসেন নামে এক কৃষক বলেন, তিনটি গরু লালন-পালন করে কোনোমতে অভাবের সংসার সামলে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ বন্যায় সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারলেও গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি বন্যার পানিতেই রেখে যেতে হয়েছে। পানি নামার পর বাড়ি ফিরে আর কিছুই পাইনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ফেনীর ভয়াবহ বন্যায় জেলা প্রাণিসম্পদ খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। অনেক এলাকা এখনো পানিতে ডুবে থাকায় সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
খামারি ও কৃষকদের সহায়তা করার বিষয়ে তিনি বলেন, জেলায় গত কয়েকদিনে ৫০০ কেজি খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওষুধ ও খাদ্য। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে সমন্বয় করে আমরা খামারি ও কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ধরনের প্রণোদনা অথবা সহায়তা আসলে তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
Leave a Reply