পূরবী পারমিতা বোস: গত রবিবার ম্যাকোয়েরি লিংকস গলফ ক্লাব হলে ‘পড়ুয়ার আসর’-এর উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলা সাহিত্যপ্রেমীরা একত্রিত হন তাঁর সাহিত্যিক অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
হুমায়ূন আহমেদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটি ছিল এক অনন্য আবেগঘন মিলনমেলা। তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাট্যকর্ম ও চলচ্চিত্র সৃষ্টির নানা দিক আলোচনায় উঠে আসে। বক্তব্যে বক্তারা বলেন, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এক অনন্য জাদুকর, যাঁর লেখনী সাধারণ মানুষের জীবনকে নতুন ভাষা ও অনুভূতি দিয়েছে। পাঠকের মনোজগৎকে কীভাবে স্পর্শ করতে হয়, তিনি তা নিখুঁতভাবে জানতেন।

অনুষ্ঠানে তাঁর জনপ্রিয় রচনার কয়েকটি অংশ পাঠ করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা স্মরণ করেন তাঁর রসাত্মক ভাষা, মানবিক চরিত্র বিন্যাস এবং বাংলা সাহিত্যকে নতুন পাঠক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অসামান্য দক্ষতা। অনেকেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন কিভাবে তাঁর একটি বই, একটি চরিত্র বা সংলাপ তাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে।

গান, কবিতা, স্মৃতিচারণ ও পাঠের সমন্বয়ে সাজানো এই আয়োজনটি শুধু স্মরণসভাই নয়, বরং ছিল সাহিত্যভিত্তিক এক উষ্ণ মানবিক সংলাপ। প্রবাসে থেকেও হুমায়ূনভক্তদের এমন সমবেত অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানের আবেগকে আরও তীব্র করে তোলে।

পড়ুয়ার আসর’ এর উদ্যোগে আয়োজিত হুমায়ূন আহমেদ স্মরণানুষ্ঠান ‘প্রিয় পদরেখা’ পাঁচটি পৃথক পর্বে সাজানো ছিল, যেখানে স্থান পেয়েছিল পাঠ, মোড়ক উন্মোচন, সম্মাননা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা সব মিলিয়ে এক অনন্য বিকেল উপহার দেয় উপস্থিত দর্শকদের।

প্রথম পর্ব: পাঠে ফিরে দেখা হুমায়ূনের জাদু
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় সংগঠনের সদস্যদের কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদের নির্বাচিত রচনা পাঠের মাধ্যমে। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ থেকে আহৃত অংশগুলো নতুনভাবে ভাবায়, হাসায়, কখনো আবার নীরবে ছুঁয়ে যায় মন। পাঠ-পর্বে অংশ নেওয়া পড়ুয়ারা জানান হুমায়ূনের লেখা উপস্থাপন করা মানে তাঁর অনুভব জগতের সঙ্গে নতুন করে সংযোগ স্থাপন।

পাঠপর্বের শেষ অংশে মঞ্চে জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রিয় দুই চরিত্র হিমু ও রূপা।
হিমুর চরিত্রে মাজনুন মিজান, আর রূপার ভূমিকায় রুপন্তী আকিদ এমন স্বাভাবিকতা ও নিবেদনের সাথে অভিনয় করেন যে মনে হয় যেন হুমায়ূনের লেখা চরিত্রগুলি সত্যিই বই ছেড়ে মঞ্চে নেমে এসেছে।

হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি আর রূপার নীল শাড়ি সব মিলিয়ে দর্শকদের কাছে অভিনয়টি হয়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ এক সাহিত্যিক দৃশ্যরূপ।
এই পর্বটিই পুরো অনুষ্ঠানের আবেগময় ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
দ্বিতীয় পর্ব: লেখকের জন্মদিন উপলক্ষে স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন সাহিত্যপ্রেমীদের গভীর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে তাঁকে সম্মান জানাতে পড়ুয়ার আসর প্রকাশ করে একটি বিশেষ স্মরণিকা।
এই স্মরণিকায় স্থান পেয়েছে তাঁর সাহিত্য, জীবনদর্শন, পাঠকের অনুভূতি ও গবেষণামূলক নানা লেখা।
স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন লেখকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠিনী নাসরিন গনি, সঙ্গে ছিলেন পড়ুয়ার সদস্যরা।
মোড়ক উন্মোচনের মুহূর্তে পুরো হলজুড়ে নেমে আসে নীরব সম্মান, লেখকের প্রতি প্রজন্মের ভালোবাসার যৌথ সুর যেন মিলেমিশে ওঠে এক আবেগঘন তরঙ্গে।
তৃতীয় পর্বঃ সিডনির চার গুণীজনকে বিশেষ সম্মাননা
অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্ব ছিল সিডনি বাংলা কমিউনিটির প্রতি নিবেদন ও অবদানের স্বীকৃতির মুহূর্ত। বাংলা ভাষা, বাংলা গান এবং কমিউনিটির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করার দীর্ঘদিনের কাজের জন্য চারজন গুণী ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন সালেহা নবী, বাংলা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নিরলস প্রহরী; গামা আব্দুল কাদির, কমিউনিটি সংগঠনের নিবেদিত কর্মী;
সিরাজুস সালেকীন, সিডনির বাংলা সংস্কৃতি চর্চার ধারাবাহিক নির্মাতা; এবং ড. রফিক ইসলাম, যিনি প্রবাসে বাংলা সাহিত্য-মনন ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ছাপ।এই পর্বটি পুরো আয়োজনের মধ্যে একটি মর্যাদাপূর্ণ, অনুপ্রেরণাদায়ী স্পর্শ এনে দেয়।
চতুর্থ পর্ব: স্মৃতিচারণ, হুমায়ূনকে কাছে দেখেছেন যারা, তাঁদের কণ্ঠে উঠে আসে অজানা বহু গল্প।অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আবেগঘন পর্ব ছিল স্মৃতিচারণ। হুমায়ূন আহমেদের নিকটজন, সহপাঠী, সহকর্মী আর শিল্পীরা যখন কথা বলছিলেন, পুরো হল যেন স্তব্ধ হয়ে শুনছিল তাঁর ব্যক্তি জীবনের অজানা গল্পগুলো।
স্মৃতিচারণে অংশ নেন জনপ্রিয় অভিনেতা ও তাঁর বহু নাটকের অভিনয়শিল্পী মাজনুন মিজান, ড. শাফিন রাশেদ, ড. আলি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠিনী নাসরিন গনি এবং বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট অজয় দাসগুপ্ত।তাঁদের প্রত্যেকের স্মৃতিতে উঠে আসে হুমায়ূনের অসাধারণ মানবিকতা, রসিকতা, সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রবাসেও পাঠকের সঙ্গে তাঁর অটুট যোগসূত্র।
পর্বটি পরিচালনা করেন ড.শাখাওয়াত নয়ন, যিনি এই আবেগময় অংশটিকে সুসংহত ও পরিমিত ভাষণে আরও মর্যাদাবান করে তুলেছিলেন।
পঞ্চম পর্ব: মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা- এই পর্বে মঞ্চ রঙিন হয়ে ওঠে আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনায়।এই পর্বের শুরুতেই
দ্বৈত পরিবেশনায় রোকেয়া আহমেদের আবৃত্তি ও এহসান আহমেদের গান দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি।এই পর্বে বড়দের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোররাও অংশ নেয়; নাচ, গান, আবৃত্তিতে তারা মঞ্চকে আরও উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত করে তোলে।
এ যেন সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হস্তান্তরের এক সুন্দর মুহূর্ত একই মঞ্চে দুই প্রজন্মের শিল্পীর সমান উজ্জ্বল উপস্থিতি।
এছাড়াও এই আয়োজনে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল প্রশান্তিকা বই ঘরের উপস্থিতি ।তারা তাদের সংরক্ষিত হুমায়ুন আহমেদের সব বই সংগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে উক্ত আয়োজনে, যাতে উপস্থিত হুমায়ুনপ্রিয় পাঠকরা এক জায়গায় লেখকের সম্পূর্ণ রচনাসমগ্র দেখার ও সংগ্রহের সুযোগ পান।
‘প্রিয় পদরেখা’ শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়; এটি ছিল প্রবাসী বাংলা কমিউনিটির হৃদয়ছোঁয়া শ্রদ্ধা, স্মরণ ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।
হুমায়ূন আহমেদের স্মরণে সাজানো এই পাঁচ পর্বের আয়োজন প্রমাণ করেছে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রবাসেও কতটা শক্তভাবে বেঁচে থাকে, যদি থাকে ভালোবাসা ও মানুষের আন্তরিকতা।
পড়ুয়ার আসরের এই অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে সিডনির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক স্মরণীয় সংযোজন হয়ে থাকবে। হুমায়ূন আহমেদের প্রতি ভালোবাসা ও প্রবাসে বাংলা চর্চার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।