নারীরা যুগে যুগে প্রমান করেছে যে তারা কোন কাজেই অপারগ বা পুরুষের তুলনায় অসমর্থ নয়। তবুও, আজকের এই দিনে দাঁড়িয়েও, শুধু আমাদের দেশেই নয়, এমনকি উন্নত বিশ্বেও একই কাজ করার জন্য পুরুষের চাইতে নারীকে কম সম্মানী দেওয়া হয়, হোক না সে অন্য সব কিছুতে পুরুষের সমকক্ষ। আজও কোনো নারী নিজের চেষ্টায় ওপরে উঠলে বলা হয়, “She’s broken the ‘Glass Ceiling'”!!
অর্থাৎceiling বা দেওয়াল যা-ই বলি না কেন, (সেটাকে কাঁচের বলা হচ্ছে কারণ সেটা আছে যদিও, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তা চোখে পড়ে না), সেই অদৃশ্য ব্যাপারটা না ভেঙে তার পক্ষে ওঠা সম্ভব হয় নি। তারপরও তাকে শুনতে হয় অনেক অবমাননাকর কথা।
সৃষ্টির শুরু থেকেই নারী কিন্ত সমাজ সংসারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে তার এই ‘স্বাভাবিক’ শরীরবৃত্তিক অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই। কখনোই তার শরীর তার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরুষ তার গায়ের জোরএর অপব্যাবহার করে তাকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে।
পুরুষ যেদিন বুঝলো brute force ছাড়া আর কোনো কিছুতেই নারী তাদের অসমকক্ষ নয়, সেদিন থেকেই ছলে বলে নারীকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। নারী যদি কোনভাবে কোন position of power এ চলেই যায়, পুরুষের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, তাই অন্তত কিছু কিছু ব্যাপারে চেষ্টা করেও নারী যেন সেখানে পৌঁছাতে না পারে, সেটার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে ধর্মীয় ফতোয়ার।
যুগে যুগে, সমস্ত সমাজে, সব ধর্মের প্রণেতারাই এক সুরে গেয়েছেন, এক কথাই নানাভাবে বলেছেন, “নারী নরকের দ্বার”; “পথে নারী বিবর্জিতা”; “নাও, ঘোড়া, নারী, যে চড়ে তারই”;
এমন হাজারো প্রবচন মুখে মুখে নারীর অবমূল্যায়ন করে গেছে এতদিন, শুধু তাই না নারীও তাকে নিয়ে বানানো এমন অনেক প্রবচনকে সত্য বলে শুধু যে মেনেছে, তা-ই নয়, ঘরের দেওয়ালে নিজের হাতে সেলাই করে ঝুলিয়েও রেখেছে!
“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, রমণী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে”,
“ভাই বড়ধন রক্তের বাঁধন, যদিও বা পৃথক হয় নারীর কারণ”
“রান্ধি বাড়ি যেবা নারী, পুরুষের আগে খায়, ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়”!!
বেশী লেখাপড়া করলে বৈধব্য অবধারিত, সেটা নিশ্চয়ই শুনেছেন, তবে অতিরিক্ত চিন্তা করলে সে নারী বন্ধা হবে, জানতেন কি? এমনই কত শত ভয় দেখিয়ে মেয়েদের এতদিন “আগলে রেখে” (পড়ুন, পিছিয়ে রেখে), আজ কিনা নারী কাজীও হতে চায়!! নাহয় কয়েকজন দুর্বিনীতা মহিলা এদিক সেদিক কিছু বড়সড় কাজ করেই ফেলেছে, তাই বলে এটাও!! Is nothing sacred anymore??
কি লাভ হল তবে ক্ষণার জিভ কেটে ফেলে, দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করে কিম্বা জোন(of Arc)কে পুড়িয়ে মেরে? আজও মাথা চাড়া দিলেই তাদের দুশ্চরিত্রা বলে, অবাধ্য হলে ঘরবন্দী করে, বা প্রতিবাদী হলে ধর্ষণ কি কিছু কম করা হচ্ছে? তবু মেয়েরা কিছুতেই কেন যে বোঝে না তাদের জন্ম এবং বেঁচে থাকাটাও আমাদের কৃপায়, বেড়ে ওঠা আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য বা সন্তান উৎপাদন করার জন্য। বিনিময়ে মাথার ওপর ছাদ, গায়ে কাপড় আর পেটে দুটো দানা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলে তো এমন সমস্যা হয় না! তা তো হচ্ছেই না, তারা আমাদের সমকক্ষ হতে চায়! আমাদের!!!
এভাবে লিখছি বলে পৃথিবীর তাবৎ পুরুষকে কখনোই এক কাতারে ফেলতে চাই না। ভাল মানুষ এখনো আছে, তবে এ লেখা তাদের জন্য নয়।
যে রক্তধারা অমৃত সুধা হয়ে নতুন প্রাণের উন্মেষ ঘটায়, লালন করে, জন্ম দেয়, সেই অমৃত ধারাকেই অশুচি বলে নিজের জন্মকেই কলঙ্কিত করল যে গুটিকয়েক অপদার্থ, সেটুকু বোঝার মত ধূসর পদার্থ হয়ত তাদের মাথায় নেই, কিন্তু পুরো দেশটার সবাই কি বোবা হয়ে গেছে? নিজের পৌরুষ প্রমাণ করতে হলে নারীর নারীত্বের অবমাননা নয়, তাকে স্বীকৃতি দিন। তাকে বেশী দেওয়ার দরকার নেই, কিন্তু যেটুকু তার প্রাপ্য, সেটুকু তাকে অবশ্যই দিন।
সুতপা বড়ুয়া
সিডনি
Leave a Reply