মানব দেহ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো খাদ্যগ্রহন।শরীরের সুস্থতা এবং অসুস্থতা উভয়ই নির্ভর করে প্রতিদিনের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের খাদ্য।আমাদের খাবার গ্রহন নির্ভর করে খাবার কতখানি সুস্বাদু তার উপর আর খাবারকে সুস্বাদু করতে মশলার ভূমিকা অনস্বীকার্য।যুগ যুগ ধরে মশলা খাবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নানারকম মশলার কারণেই খাবার দেখতে যেমন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তেমনি স্বাদে গন্ধে হয়ে ওঠে মুখোরোচক।
যে কোনো মশলা হচ্ছে কোন গাছের বীজ,ফল, মূল,বাকল বা পাতা যা মূলত খাবারকে আকর্ষণীয় রং দিতে, খাবারে সুঘ্রাণ আনতে এবং খাবার সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়।মশলার ব্যবহার হয় বিভিন্ন রূপে যেমন-টাটকা,শুকনো,গোটা বা পিষে।মশলার সুঘ্রাণের উৎস হল মশলায় থাকা বাষ্পীভূত হতে সক্ষম এক ধরনের তেল যা বাতাসের সংস্পর্শে জারিত হয়।স্মশলা বাটলে মশলার পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পায়।যার জন্য মশলার জারণের হার বৃদ্ধি পায়।ফলে ঘ্রাণটা হয় অসাধারণ।
স্পাইস শব্দটি প্রাচীন ফরাসি শব্দ espice থেকে এসেছে।মসলা বলতে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, হলুদগুঁড়া,মরিচগুঁড়া সবচেয়ে বেশী প্রচলিত।এছাড়াও আছে গরম মসলা হিসেবে এলাচি, দারুচিনি, তেজপাতা, লবঙ্গ। বর্তমানে তারা মসলা বা স্টার অ্যানিসকেও গরমমসলা হিসেবে ধরা হয়।পাঁচ রকম মসলার মিশ্রণে তৈরি হয় পাঁচফোড়ন। এতে থাকে ধনে, সর্ষে, মেথি, কালিজিরা, মিষ্টি জিরা।মশলা ব্যবহারের ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায় যে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত উপমহাদেশে দারুচিনি ও কালো মরিচ দিয়ে এবং পূর্ব এশিয়ায় ভেষজ ও মরিচ দিয়ে মশলার বাণিজ্য শুরু হয়।উৎপাদিত এই মশলাগুলো নিয়ে ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রথম মশলার বাণিজ্য ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। প্রাচীনকালে মিশরীয়রা মশলা ব্যবহার করত মমি তৈরীতে। এজন্য তাদের প্রয়োজন হত প্রচুর পরিমাণে বিদেশী মশলার। তাদের এই আজব খেয়ালই বিশ্বজুড়ে মশলার বাণিজ্যকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে চীন,কোরিয়া এবং ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা মশলানির্ভর হয়ে পড়ে। প্রাচীনকালে মশলার ব্যবহার ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে রান্নাবান্না, খাদ্য সংরক্ষণ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নৈবেদ্য, মৃতদেহ সৎকার, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা, রূপচর্চা প্রভৃতি ক্ষেত্রে। মসলাকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে অনেক বড় বড় যুদ্ধও হয়েছে। মসলার জন্য প্রথম যুদ্ধ হয় ভারতবর্ষে। পর্তুগীজদের সাথে কালিকটের রাজার মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।এই মসলার খোঁজেই পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামা একদিন জাহাজ ভেড়ান ভারতের কেরালা উপকূলে। পরবর্তীতে মসলার একচেটিয়া বাণিজ্য পর্তুগীজদের হাতে চলে আসে। প্রায় দেড়শ বছর পর্যন্ত মসলার বাণিজ্য তাদের হাতেই ছিল।এমনকি ইংরেজদের বিখ্যাত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ও এক সময় মসলার বাণিজ্যে নেমে পড়ে। মধ্যযুগে ইউরোপেও মশলার ব্যবহার শুরু হয়। তারপর আরব এবং আফ্রিকান বণিকদের সৌজন্যে মশলা বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ে পুরো পৃথিবীতে।বর্তমানে মশলা সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে বড় বড় মশলার বাজার।
ইতিহাসবিদদের মতে,পরবর্তী জীবনের পূর্ণতা ও দীর্ঘায়ু লাভই নাকি এসব মশলা ব্যবহারের অন্যতম কারণ।প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসাব্যবস্থায় পেঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতা, মেথি, মৌরি, গোলমরিচসহ আরো নানা মশলার আধিপত্য ছিল। তৎকালীন মিশরীয়রা পেঁয়াজ, রসুনসহ অন্যান্য কাঁচা মশলাকে সুস্বাস্থ্য, সুদৃঢ় মনোবল এবং আদর্শ খাদ্যাভ্যাসের প্রতীক বলে মনে করত। এমনকি ফারাওদের পিরামিডে তাদের কফিনের কাছে এসব মশলা রেখে দেয়া হতো বলেও শোনা যায়।এছাড়াও মিশরীয়দের দৈনন্দিন খাবারে এলাচি ও দারুচিনি ছিল অপরিহার্য যা আসত সুদূর ইথিওপিয়া থেকে।
এছাড়াও বিভিন্ন চীনা প্রবাদ ও মিথোলজিতেও রয়েছে মশলার দারুণ সব আখ্যান।
খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৮ম শতকে বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ এড়াতে দারুচিনি ও হলুদ ব্যবহার করতেন চিকিৎসকেরা। এছাড়াও ভূতপ্রেত কিংবা বিভিন্ন অশুভ ছায়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে সাদা সরষে, গোলমরিচসহ বিভিন্ন তীব্র সুগন্ধী মশলার ব্যবহারের কথাও শোনা যায়। কাটাছেঁড়া, শূলবেদনাসহ ত্বকের বিভিন্ন সংক্রমণ এড়াতে তৎকালীন ভারতীয়রা এলাচ, হলুদ, দারুচিনি, সরষে, গোলমরিচ, আদাসহ বেশ কিছু মশলা ব্যবহার করতেন। আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞদের মতে, লবঙ্গ ও এলাচ দিয়ে পান মুড়িয়ে খেলে তা হজমসহ বিপাকক্রিয়ায় বেশ সাহায্য করে আর মশলার এই প্রচলন সুদূর ভারতবর্ষ থেকেই এসেছে বলেও ধারণা করা হয়।
পুষ্টিবিদদের মতে, মশলায় ফাইটো নিউট্রিয়েন্টস থাকে যেটা আমাদের শরীরের সুস্থ কোষগুলিকে ক্যানসার কোষে রূপান্তরিত হতে বাধা দেয়।বিভিন্ন মশলায় রয়েছে আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট,খনিজ লবণ,এসেনসিয়াল অয়েল ও ভিটামিন।মশলা অন্ত্রে অতিরিক্ত এনজাইম ক্ষরণে যেমন সাহায্য করে তেমনি বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক তৈরীতেও মূল ভূমিকা পালন করে।তবে বেশী মসলার ব্যবহারও শরীরের জন্য হতে পারে মারাত্মক ক্ষতিকারক।বুক জ্বালা, চোখ ভালো রাখা, কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হাড়ের জয়েন্ট-এ ব্যথা এবং আলসার জাতীয় যে-কোনও রোগের কারণ হতে পারে মশলার প্রচুর ব্যবহার।
এবার জানাই বিশ্বের কিছু দামী মসলার কথা।এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মসলা হলো জাফরান। জাফরান ক্রোকাস উদ্ভিদ থেকে জাফরান মসলা সংগ্রহ করা হয়। এই উদ্ভিদটি বর্তমানে দক্ষিণ ফ্রান্স, ইরান, স্পেন, ইতালি, মরক্কো ও গ্রিসে চাষ করা হয়।মসলা হিসেবে জাফরান অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ার কারণ এর উৎপাদন প্রক্রিয়া।
আরো একটি সবচেয়ে দামি মসলা হলো ভ্যানিলা। এর দামেরও মূল কারণ উৎপাদন প্রক্রিয়া। ভ্যানিলা গাছের পড থেকে মূলত মসলা হয়ে থাকে।ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে দামি মশলার তালিকার শীর্ষে আছে গোলমরিচ। এই মসলাটি আজ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মশলা। কয়েক শতাব্দী ধরে এটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলা ছিল।এছাড়াও দামী মসলার তালিকায় আছে এলাচ,দারচিনি,জিরা,পোস্তদানা,হিং।
কিছু মশলার অতিরিক্ত ব্যবহারে হতে পারে বড় বড় রোগ। একটু অনিয়ম করলেই খারাপ প্রভাব পড়তে পারে শরীরে।বিশেষ করে গরমে অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো।রসুন,গোলমরিচের গুঁড়ো,লাল মরিচের গুঁড়ো অতিরিক্ত গরমে কম ব্যবহার করা ভালো।
যুগের পর যুগ মসলার ব্যবহার খাবারের স্বাদ গন্ধকে করেছে অতুলনীয় এই মসলার বানিজ্য নিয়ে হয়েছে কত না যুদ্ধ তাই সুস্থ থাকতে নানা রূপে মসলার ব্যবহার হোক পরিমিত।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
লিখেছেন মঞ্জুশ্রী মিতা
Leave a Reply