ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার পরিকল্পনা ঢাকাতে বসেই হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ।
তিনি জানান, মূল পরিকল্পনা চলছিল দু-তিন মাস ধরে। পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি ফ্ল্যাটে একাধিক বৈঠক করেছিলেন হত্যাকারীরা।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেলে ডিবি কার্যালয়ে এমপি আনার হত্যার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন ঢাকার ডিবিপ্রধান।
তিনি জানান, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি ফ্ল্যাটে একাধিক বৈঠক করেছিলেন হত্যাকারীরা। দু-তিন মাস ধরে চলে এই পরিকল্পনা। ভিকটিম (এমপি আনার) প্রায়ই কলকাতায় আসা-যাওয়া করতেন। তাই কলকাতার মাটিতেই তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন সবাই মিলে। পরিকল্পনা মোতাবেক মূল হত্যাকারী আমানুল্লাহ তার সহযোগী তানভীর ভূঁইয়া এবং আখতারুজ্জামান শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমান গত মাসের ৩০ তারিখ যান কলকাতায়। সেখানে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। কলকাতায় আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন আখতারুজ্জামানের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মূল হত্যাকারীর নাম শিমুল ভূঁইয়া হলেও তিনি আমানুল্লাহ আমান নামে নতুন একটি পাসপোর্ট করে সেখানে যান।
হারুন অর রশীদ আরও জানান, হত্যার পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে ফিরে আসেন আখতারুজ্জামান। এমপি আনার যে ১২ মে কলকাতায় যাবেন তা আগে থেকেই জানতেন আখতারুজ্জামান। ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান এমপি আনার। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা।
ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, ফয়সাল নামে এক ব্যক্তি এমপি আনারকে ১৩ মে দুপুরে সাদা গাড়িতে রিসিভ করে। পরে মূল হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারী আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভুইয়া ও ফয়সালসহ আনার ওই ফ্ল্যাটে যান। মোস্তাফিজ নামে আরও একজন ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। জিহাদ ও সিয়াম নামে হত্যাকণ্ডে জড়িত আরও দুজন সেখানে ছিলেন। দুপুর ২টা ৫১ মিনিটে এমপি আনার ওই বাসায় যান। এ সময় তারা এমপির কাছে আখতারুজ্জামানের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলেন। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন। মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন করেন হত্যাকাণ্ড। হত্যার পর আমান বিষয়টি আখতারুজ্জামানকে জানান।
লাশ খণ্ডবিখণ্ড করা হয় জানিয়ে ডিবির হারুন বলেন, আখতারুজ্জামানের পরামর্শমতো লাশ গুম করতে এমপি আনারকে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর ফ্ল্যাটের কাছেই শপিংমল থেকে আনা হয় দুটো বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। পরে টুকরোগুলো পলিথিনে পেঁচিয়ে ট্রলিব্যাগে ভরা হয়। এরপর লাশ খণ্ডবিখণ্ড করে মসলা মিশিয়ে ট্রাভেল ব্যাগে করে ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন দিন বাইরে বের করে নিয়ে যায়। ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে ঘরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে তারা।
আমানের স্বীকারোক্তি ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পরদিন বিকেলে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হন আমান। জিজ্ঞাসাবাদে তিন পুলিশকে জানিয়েছেন, বাসা থেকে বের হয়ে পাশের একটি শপিংমলের সামনে ট্রলিব্যাগটি তিনি সিয়ামের হাতে তুলে দেন। সিয়াম ব্যাগ নিয়ে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যান। আরেকটি ব্যাগ বাসাতেই ছিল। ওই ব্যাগ থেকে দুর্গন্ধও ছড়ানো শুরু করেছিল। সহযোগীদের ট্রলিটি অন্য কোথাও ফেলে দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে ১৫ মে শিলাস্তিকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি।
মরদেহ পাওয়ার আশা খুবই কম জানিয়ে ডিবির হারুন জানান, তারপরও চেষ্টা করছি কিছু খণ্ড অন্তত উদ্ধার করার। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী আমানুল্লাহ ছদ্মনাম, তার নাম শিমুল ভূঁইয়া। তিনি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। বর্তমানে আমানুল্লাহ ও পরিকল্পনাকারী শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমান ডিবির হাতে আটক রয়েছে। তাদের থেকেই হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা জানা গেছে।
তিনি বলেন, এমপি আনারকে হত্যার পর শাহিনের গার্লফেন্ড শিলাস্তি ও খুনি আমানুল্লাহ ১৫ মে এবং মোস্তাফিজ ১৬ তারিখ ঢাকায় ফেরেন। এরপরেই ভিস্তা এয়ারলাইন্সে করে মূল পরিকল্পনাকারী শাহিন দিল্লি হয়ে কাঠমাণ্ডুতে চলে যান। বর্তমানে তিনি পলাতক আছেন।
হারুন বলেন, ১৮ তারিখ গোপাল বিশ্বাস বন্ধু আনার নিখোঁজের ঘটনায় জিডি করেন। পরে হত্যাকারীরা ভিকটিমের মোবাইল থেকে কল ও মেসেজ দিয়ে বিষয়টিকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করে। ১৮ তারিখের পর দিল্লি যাচ্ছি জানিয়ে এমপি আনারের ফোন থেকে বার্তাও দেয়া হয়।
কলকাতা পুলিশের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে জানিয়ে হারুন বলেন, একটি টিম আজ বাংলাদেশে আসছে। প্রয়োজনে আমরাও সেখানে গিয়ে তদন্ত করব।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আখতারুজ্জামান শাহীন! শাহীন ঝিনাইদহের বাসিন্দা ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তার ভাই সহিদুজ্জামান ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র।
Leave a Reply