অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী বাঙালিদের ঐক্য ও সংস্কৃতির এক অনন্য প্রকাশ ঘটলো ‘বিজয়া সম্মিলনী ২০২৫’-এ। শনিবার, ৮ নভেম্বর সিডনির শহরতলী ক্যাম্পসির অরিয়ন ফাংশন সেন্টারে আয়োজিত এই মহোৎসবে অংশ নেয় অস্ট্রেলিয়ার ২৪টি সংগঠন। সার্বিক আয়োজনের নেতৃত্বে ছিল Australian Federation for Ethnic and Religious Minorities in Bangladesh Limited (AFERMB)।

দুর্গাপূজার পর বাঙালির চিরচেনা মিলন-উৎসব বিজয়ার এই পুনর্মিলনী চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ,“অসুরের বিনাশ হোক, শুভ হোক বিশ্বলোক”, যা শুভশক্তির জাগরণ, মানবতার বিকাশ ও শান্তির বার্তা বহন করে।

উৎসবের সূচনা হয় বিকেল পাঁচটায়। কান্ট্রি অ্যাকনলেজমেন্ট ও বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর পরমেশ ভট্টাচার্য ও অপু সাহা মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন করেন। ঢাক, শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে অরিয়ন ফাংশন সেন্টার। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন শুভ্রা সাহা। নতুন প্রজন্মের শিশুদের গীতা পাঠ ও ‘রাধা কৃষ্ণ গৌড়ীয় মন্দির’-এর বাল্যশিক্ষার্থীদের পরিবেশনা অনুষ্ঠানে আনে ভক্তি, আনন্দ ও নিষ্পাপ আবহ।

এরপর প্রদর্শিত হয় নির্মাতা আকাশ দে-র একটি প্রামাণ্য ভিডিও, যেখানে দেখা যায় সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত সহিংসতার দৃশ্য। ভিডিওর সেই বেদনাময় চিত্রে উপস্থিত অনেকেই চোখের জল লুকাতে পারেননি। বক্তারা বলেন, “প্রবাসে থেকেও আমরা বাংলাদেশের বহুত্ববাদ ও সহনশীলতার পক্ষে কণ্ঠ তুলতে চাই।”

অনুষ্ঠানের শুরুতেই AFERMB-র সভাপতি সুরজিৎ রায় ঐক্য ও মানবতার পক্ষে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এই বিজয়া সম্মিলন কেবল উৎসব নয় এটি আমাদের সহাবস্থান ও সম্মিলিত চেতনার প্রতীক।” ২৪ সংগঠনের প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে এই ঐক্যের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

এবারের সম্মিলনে একটি বিশেষ সংযোজন ছিল স্পন্সর ও সহযোগীদের সম্মাননা। আয়োজকেরা তাঁদের হাতে দৃষ্টিনন্দন ক্রেস্ট তুলে দেন কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফেডারেল পার্লামেন্টের সদস্য ও বার্টনের এমপি অ্যাস অ্যাম্বিহাইপার, হিউজের ফেডারেল এমপি ডেভিড মনক্রিফ, হিন্দু কাউন্সিল অব অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল সেক্রেটারি শোভা দেশিকান এবং চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস ইন্ডিজিনিয়াস জুম্মা অ্যাসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়ার এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য কবিতা চাকমা এবং তাঁরা তাদের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। তাঁরা বলেন, এ ধরনের উৎসব কেবল বাঙালি সম্প্রদায়কেই নয়, বরং অস্ট্রেলিয়ার বহুসাংস্কৃতিক সমাজকেও সমৃদ্ধ করে।

অনুষ্ঠানে এমপি ডেভিড মনক্রিফ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন AFERMB–এর নতুন প্রকাশনা “Global Lense”–এর প্রথম সংখ্যা। আয়োজকদের ভাষায়, এই নিউজলেটার হবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কণ্ঠস্বর যেখানে স্থান পাবে মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সংখ্যালঘুদের সংগ্রামের গল্প।
দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যার সঞ্চালনায় ছিলেন হিমেল ও শাওলি ভৌমিক। স্থানীয় শিল্পীরা পরিবেশন করেন স্তোত্রপাঠ, রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত, কবিতা আবৃত্তি ও নৃত্যনাট্য। শিশুদের উপস্থাপনায় দেবী দুর্গা ও মহিষাসুরের প্রতীকী নাট্যাংশ দর্শকদের গভীর প্রশংসা কুড়ায়।

সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সিঁথি সাহা। তিনি একে একে পরিবেশন করেন জনপ্রিয় সব গান। তাঁর মায়াময় কণ্ঠে সুরের আবেশে মেতে ওঠে পুরো অরিয়ন হল। দর্শকেরা করতালি, নৃত্য ও আনন্দে ভরিয়ে তোলেন পরিবেশ।
অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে AFERMB বোর্ড অব ডিরেক্টরসের চেয়ারপার্সন ড. সমীর সরকার সকল সংগঠন, শিল্পী ও অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, “এই বিজয়া সম্মিলন কেবল আনন্দের উৎসব নয়, এটি আমাদের সামাজিক অঙ্গীকার, মানবতার আলোকিত প্রতিচ্ছবি।”
বিজয়া সম্মিলনী ২০২৫ শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় প্রবাসে বাঙালির ঐক্য, সহিষ্ণুতা ও সাংস্কৃতিক গৌরবের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে।